22/11/2025
তন্ময় আর অপালা (নাম পরিবর্তিত) – দুজনের জীবনের গল্প যেন এক অদৃশ্য কষ্টের স্রোত বয়ে নিয়ে চলছিল।
বছরের পর বছর বাচ্চার আশায় পথ চেয়ে থেকেও কিছু হচ্ছিল না। কিন্তু সেই পথও ছিল না সহজ।
প্রায় ছয় বছর আগে একদিন হঠাৎ দুর্ঘটনায় তন্ময়ের পিঠে গুরুতর আঘাত লাগে। তারপর অপারেশন হয় , ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হন। পায়ে চলাফেরার ক্ষমতাও স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু এরপর থেকেই তাঁর বীর্যপাতের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। অপালা সব জানতেন কিন্তু খুব সাপোর্টিভ ছিলেন প্রথম থেকেই।
মনে পড়ছে প্রায় দু বছর আগে যখন তাঁরা প্রথম আমাদের ক্লিনিকে আসেন, তখন তন্ময়ের বয়স ৪০ আর অপালার ৩৭। দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত, কলেজে পড়ান।
তন্ময় খুব হতাশা নিয়ে চেম্বারে ঢুকেই বলেছিলেন "ডাক্তারবাবু আমারই সমস্যা। আর এই সমস্যাটা খুব বিরল"।
অপালা তাঁকে থামিয়ে দিতে বলেছিলেন "ডাক্তারবাবু, ও সবসময় এরকম ভাবে। দেখুন আমারও বয়স হয়েছে, এটা ওকে বোঝাই সবসময়। আসলে আমরা বাচ্চা চাইছি, এবার আপনি বলুন কি করা যায়?"
অপালা ও তন্ময়কে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হল।
তন্ময়কে বোঝানো হল "এই সমস্যা অনেকেরই হয়। তবে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন এবার আমি করব, সেটা চিকিৎসার স্বার্থেই"।
তন্ময় কষ্ট চেপে বললেন "ডাক্তারবাবু আমার আর কিছু ব্যক্তিগত নেই। জানেন, যেখানেই গেছি সেখানেই আমার শরীরের একান্ত ব্যক্তিগত অংশের পরীক্ষা করা হয়েছে। কত জায়গায় দেখিয়েছি জানেন? ইউরোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট , সাইকিয়াট্রিস্ট, ফার্টিলিটি সেন্টার কত জায়গায়? জানেন দুবার TRUS (transrectal ultrasound) করিয়েছি আর TRUS করানোর সময় টেকনিশিয়ান রাও সামনে ছিলেন। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন কি জানতে চান?"
প্রশ্ন করা হল: "দেখুন অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্যার কারণ হল লিঙ্গ শিথিলতা বা ED। আর সেটা ঠিক করলেই ej*******on বা বীর্যপাত ঠিক হয়ে যায়।"
তন্ময়ের উত্তর "না ডাক্তারবাবু, সেই সমস্যা নেই। আগের ডাক্তারও বলেছিলেন যে ED থাকলে চিকিৎসা সহজে হয়। কিন্তু সে সমস্যা আমার নেই"।
বুঝলাম, এটা খুব সহজ হচ্ছেনা। ভাবলাম পরের সমস্যাটা নিয়ে কথা বলি, "আচ্ছা। অনেক পুরুষ আছেন যাঁদের সহবাসের সময় বীর্যপাত হয়না কিন্তু হস্তমৈথুনের সময় হয়। আমরা এরকম অনেককেই পেয়েছি। তাঁদের ক্ষেত্রে IUI বা আইভিএফ না করেও প্রেগন্যান্সি আসে অনেক সময়। বাড়িতে তাঁরা self insemination করতে পারেন।"
তন্ময় প্রায় চোখে জল নিয়ে বললেন "আমি সেটা আপনার ফেসবুক পোস্টে পড়েছি। কিন্তু পিঠে আঘাত লাগার পরে সেই ক্ষমতাও আমার চলে গেছে।"
তখন আরেকটা উপায়ের কথা বললাম "আমরা অনেকসময় দেখি reteograde ej*******on হয়, অর্থাৎ সিমেন সামনের দিকে না এসে প্রস্রাবের থলিতে চলে যায়। ইউরিন থেকে স্পার্ম নিয়ে তখন IUI বা আইভিএফ করা যায়। আমরা এক্ষেত্রে PMU বা post ma********on urine টেস্ট করতে বলি।"
হতাশ গলায় তন্ময় বললেন "আর আশা দেখাবেন না। ওই টেস্ট টাও আমি চারবার করেছি, তাতেও কোন স্পার্ম পাওয়া যায়নি"।
এবার তার পরের অস্ত্র টা ব্যবহার করলাম, "আচ্ছা আপনার কি night falls হয়? তাহলে বিশেষ ধরনের কন্ডম (non toxic condom) ব্যবহার করে আমরা সেই শুক্রাণু সংগ্রহের চেষ্টা করতে পারি।"
"না, ডাক্তারবাবু তাও হয়না।"
এবার ভাবলাম, সহজ সব কিছু তো আর করা যাচ্ছেনা। তাহলে তারপরের টা দেখি, "তাহলে একটা উপায় আছে, যদিও একটু অস্বস্তিকর। সেটা হল প্রস্টেট ম্যাসেজ করে শুক্রাণু নেওয়া। তাতে যেটা করা হয়......*
তন্ময় থামিয়ে দিয়ে বললেন, "ডাক্তারবাবু সেটাও একবার করা হয়েছে। আমি সেটা কি জানি। আমার মলদ্বারে আঙুল দিয়ে প্রস্টেট গ্রন্থি স্টিমুলেট করে ডাক্তার চেষ্টা করেছিলেন, তাতেও কিছু বেরোয়নি।"
তখন শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করলাম, "তাহলে তো একটাই উপায়, সেটা হল TESA বা testicular s***m aspiration, অর্থাৎ অজ্ঞান করে অন্ডকোষে সূঁচ ঢুকিয়ে শুক্রাণু নেওয়া আর তা আপনার স্ত্রীর শরীর থেকে নেওয়া ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করানো। একে ICSI বলে, অর্থাৎ বিশেষ ধরনের আইভিএফ"।
অপালা এবার মুখ খুললেন "ডাক্তারবাবু আমাকে সেটাই করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমার বয়স বেশি আর AMH কম। সেটা কি করা যাবে? আমরা কেউই ডোনার স্পার্ম বা ডোনার এগ নেব না।"
"ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু বয়সের কারণ সাকসেস কম হবে সেটা আর খরচ মাথায় রাখতে হবে "।
তারপর তাঁরা ICSI করার প্রস্তুতি নিলেন। TESA করে তন্ময়ের অন্ডকোষ থেকে স্পার্ম পাওয়া গেলো। অপালাকে ইনজেকশন দেওয়ার পর তাঁর থাকে মাত্র দুটো ডিম্বাণু পাওয়া গেল। ICSI করা হল। কিন্তু ভ্রূণের কোয়ালিটি খুব একটা ভাল হলনা। তাই প্রথমবার আইভিএফ ব্যর্থ হলো। হতাশায় ভেঙে পড়লেন দুজনেই।
আবার প্রায় ছয় মাস বাদে এলেন দুজনে গত সপ্তাহে। এখন অপালার বয়স ৩৯। বোঝানো হল নিজের ডিম্বাণু দিয়ে সম্ভাবনা খুব কম। তাও বললেন "হলে নিজেদের ডিম্বাণু আর শুক্রাণু দিয়েই করব। যদি না হয়, হবেনা। বাচ্চা না হোক, না হবে। কিন্তু ডোনার নেবনা*।
বললাম, "ঠিক আছে। ডোনার নিয়ে তো আমরা জোর করতে পারিনা। এটা আপনাদের ইচ্ছা। আর স্বামী স্ত্রী দুজনের লিখিত সম্মতি ছাড়া তো ডোনার ব্যবহার করা যায়না। আর বাচ্চা না হওয়া টা তো কোন প্রাণঘাতী রোগ নয়। তাই জোর করে তো কিছু করতে পারবনা। কিন্তু আপনারা যা করবেন সব বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর খরচ মাথায় রাখবেন। সব থেকে বড় কথা সাকসেস বেশ কম সেটা ভুলে গেলে হবেনা"।
তারপর তন্ময়ের মা চেম্বারে এসে বসলেন। চোখ ভরা জল, কাঁপা কণ্ঠে হাত ধরে বললেন—
“ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে-বৌমা দুজনেই খুব ভালো। কিন্তু এই সমস্যার জন্য শ্বশুরবাড়িতে আমার ছেলেকে খুব কথা শুনতে হয়। অপালা মুখে কিছু বলে না, কিন্তু আমি তার চোখের জল প্রতিদিন দেখি। আপনি কিছু করুন, ওদের যেন বাচ্চা হয়।”
বললাম "উনাদের তো বারবারই বলা হয়েছে কি উনাদের সমস্যা কি অবস্থায় আছে"।
তন্ময় এরপর চোখের জলে বললেন—
"ডাক্তারবাবু, আমি একজন কলেজ প্রফেসর। সারাদিন ছাত্রদের জ্ঞান দিই। অথচ দেখুন আমারই কি অবস্থা হল। জানেন আমি এখন আর কোন লজ্জা করিনা। আমি জানি, চিকিৎসার জন্য এসব প্রয়োজন। আমি সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু জানেন, সেদিন কী হলো?"
তন্ময় আবার বলতে শুরু করলেন: "আমি শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। বাথরুমে যাব, হঠাৎ আমার এক শালা হাসতে হাসতে বলে উঠল— ‘জামাইবাবু, সেদিন শুনলাম ডাক্তাররা নাকি নিয়মিত আপনার যন্ত্রপাতি চেক করে। তো সেগুলো আমাদের মতই নরমাল তো, নাকি গন্ডগোল আছে?’
আমি যে চিকিৎসার নামে সব সহ্য করি, সেটা তো আমার নিজের লড়াই। কিন্তু আমার আপনজনই যদি আমার কষ্টকে উপহাসে মেশায়, তখন আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াই?”
তখন মনে হল, আমরা বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে শুধু মহিলাদের কতটা সামাজিক কটূক্তি শুনতে হয়, সেটা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু পুরুষের সমস্যা হলে সমাজ তাঁকে কি চোখে দেখে, সেটা নিয়ে কোন কথা বলিনা। যাঁরা মানবাধিকার, নৈতিকতা এসব নিয়ে এত কথা বলেন, তাঁরাই আবার বাচ্চা না হলে পুরুষকে "পুরুষত্ব হীন" বলতে ছাড়েন না।
তাই মনে হয় বন্ধ্যাত্ব শুধু রোগীর শরীরের অসুখ নয়, এতে আছে একজন মায়ের আর্তি, একজন স্ত্রীর নীরব কান্না, আর এক ছেলের লজ্জার ঘন কালো মেঘ।
মানুষকে কিভাবে "শিক্ষিত" করা যায় যে, বাচ্চা না হওয়া মানে কোন "অক্ষমতা", অন্য রোগের মতোই একটা শারীরিক সমস্যা?
আপনারা কি বলেন?