01/11/2020
🌿🌿নওগাঁয় গাঁজা চাষের ইতিহাস 🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿
🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿
নওগাঁ জেলার অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই জেলার নওগাঁ সদর, মহাদেবপুর ও বদলগাছী থানায় বৃটিশ আমলে গাঁজা চাষ হত। গাঁজা চাষের জন্য এই এলাকার মাটি উপযোগী হওয়ায় প্রায় ৯,০০০ হেক্টর গাঁজা চাষের আওতাভূক্ত করা হয়। প্রায় একশ বছর ধরে নওগাঁ থানার তিলকপুর, বোয়ালিয়া, বক্তারপুর, কীর্তিপুর, নওগাঁ , হাঁপানিয়া, বর্ষাইল, দুবলহাটি, বদলগাছী থানার বালুভরা, মহাদেবপুর থানার ধনজইল ও ভীমপুর এলাকায় গাঁজা চাষ হত। এই তিন থানা পৃথক জেলার অধীনে থাকায় ১২০ বছর পূর্বে গাঁজা চাষের সুবিধার্থে এই তিন থানাসহ অন্যান্য থানার সমন্বয়ে রাজশাহী জেলার অধীনে নওগাঁ মহকুমা গঠিতত হয়। তৎকালীন রাজশাহী জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারবলে গাঁজা সোসাইটির চেয়ারম্যান, মহকুমা প্রশাসক ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। বৃটিশ সরকার গাঁজার দাম নির্ধারণ করে দিলেও গাঁজা চাষীরা লাভ হতে বঞ্চিত হত না । গাঁজার মত আর কোন ফসল এত লাভও হত না। তাই নওগাঁ গাঁজা মহালের চাষীরা তৎকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ার সব থেকে স্বচ্ছল চাষী বলে গণ্য হতেন। গাঁজা সোসাইটির অবদানকে বাদ দিলে নওগাঁর অর্থনৈতিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় ।
গাঁজা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম। ১৭২২ সাল নাগাদ এই এলাকায় প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয় নওগাঁ সদর উপজেলার মুরাদপুর গ্রামে। অধিক লাভজনক হওয়ায় ১৮৭৭ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে গাঁজাচাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার গাঁজা উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করে। অর্থাৎ লাইসেন্সে নির্ধারিত জমি ছাড়া অন্য জমিতে গাঁজা চাষ করা যাবে না।
গাঁজা উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ১৯১৭ সালে ‘নওগাঁ গাঁজা কাল্টিভেটরস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’ নামে একটি সমবায় সমিতি গঠিত হয় এবং সে বছরই সমিতিটি সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। এভাবে ভিত্তি রচিত হয় উপমহাদেশের বৃহত্তম সমবায় সমিতির। জন্মলগ্নে সোসাইটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮ জন। অবাক করা ব্যাপার পরে এর সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৭ হাজারে।
সংরক্ষিত পরিবেশে গাঁজা চাষ করা হতো। বছরের জুন-জুলাই ছিল চারা তৈরির মাস। উঁচু মজবুত বাঁশ বা কাঠের বেড়া দিয়ে বীজতলা তৈরি করা হতো। বেড়ার চারপাশে চৌকি নির্মাণ করে পাহাড়া দিত সশস্ত্র পুলিশ। একইসঙ্গে বীজতলার অভ্যন্তরে বাঁশের টং তৈরি করে পাহাড়া দিত খোদ চাষীরা। বীজতলায় প্রবেশ ও বাহির উভয় ক্ষেত্রে পুলিশ চাষীদের দেহ তল্লাশি করত, যাতে তারা নিজেরাও চারা বাইরে পাচার করতে না পারে। চারা উপযুক্ত হলে রোপণ করা হতো। নিয়ম হলো, ৮ ইঞ্চি পরপর সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করা। উল্লেখ্য, গাঁজা উৎপাদন হয় পুরুষ গাছ থেকে। দেখতে খানিকটা গাঁদা ফুলের মতো কিন্তু ছোট এক ধরনের জটা। স্ত্রী গাছ ক্ষেতের প্রধান শত্রু। কারণ তার স্পর্শে পুরুষ গাছে জটা ধরে না, ধরে কেবল বীজের থোকা। সুতরাং স্ত্রী গাছ অপসারণের প্রয়োজন হতো। স্ত্রী গাছ চিহ্নিতকরণের জন্য নিয়োজিত থাকতো অভিজ্ঞ লোক। তাদের ‘পরখদার’ বা ‘পোদ্দার’ বলা হতো।
সাত-আট মাস পর ফেব্রুয়ারিতে জটা পরিপক্ক হলে চাষীরা গাছের গোড়া কেটে সরকার কতৃক নির্ধারিত ঘেরাও করা স্থানে প্রতিটি গাছ হিসেব করে শুকাতে দিত। নির্দিষ্ট সময় শুকানোর পর একটির পর একটি গাছ সাজিয়ে ২-৩ দিনের জন্য ভারি ইট বা পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। এরপর গাছগুলো পুনরায় রোদে শুকিয়ে সেখান থেকে জটা আলাদা করে চাপ দিতে হতো। ফলে অবশিষ্ট রসগুলো বের হয়ে যেত। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর সেগুলো সাবধানে বস্তায় ভরে সশস্ত্র পুলিশ পাহাড়ায় শহরের গাঁজাগোলা বা গুদামঘরে পাঠানো হতো। সেখানে কাঠের তৈরি বাক্সে সাজিয়ে রাখার মাধ্যমে এই কাজ শেষ হতো।
গাঁজা চাষের মৌসুমে পুরো কাজ ম্যাজিস্ট্রেটসহ মাদক বিভাগের কর্মকর্তাদের কড়া নজরে পরিচালিত হতো। পুরো এলাকায় থাকতো পুলিশ-আনসারদের পাহাড়া। অনেক সময় রাতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে উৎপাদিত গাঁজা বিক্রি হতো সোসাইটির মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির আগে উপমহাদেশে এত বড় দ্বিতীয় কোনো সমবায় সমিতি ছিল না। ১৯৮৭ সালে গাঁজা চাষ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সোসাইটির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। সে সময় বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, বার্মা, নেপাল এবং সুদূর ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের একাধিক দেশে নওগাঁর গাঁজা রপ্তানী হতো। ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার মণ গাঁজা উৎপাদন হতো। ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্যবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে ১৯৯০ সালের মধ্যে গাঁজা চাষ বন্ধের শর্ত ছিল। শর্ত মোতাবেক তিন বছর আগেই ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
গাঁজা সোসাইটির প্রধান কার্যালয় কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে গড়া। এই কার্যালয়ের সাজসজ্জার জন্য কাঠ আনা হয়েছিল নেপাল থেকে। ভবনের প্রস্তরফলক থেকে জানা যায়, ১৯২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন তৎকালীণ মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বর্তমানে নওগাঁ শহরের প্রায় সবগুলো প্রাচীন ভবনই সোসাইটির সম্পত্তি। সোসাইটির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ৪০ একর জমি, ১০০টি ভবন, ৭টি দিঘি, ১টি লেক, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৩টি মসজিদ, ১টি মন্দীর, ৪টি গুদাম ঘর, ১টি সরাইখানা এবং কো-অপারেটিভ ক্লাব। এ ছাড়াও ১টি লাইব্রেরি, ৩টি হাসপাতাল, ৩টি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১টি পশুচিকিৎসালয়, ১টি হিমাগারসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু সম্পত্তি। আসাম, কলকাতা এবং ঢাকাতেও সোসাইটির সম্পত্তি রয়েছে। শুধু তাই নয়, শাখা কার্যালয় খোলার জন্য লন্ডন শহরেও জমি কেনা হয়েছিল।
সোসাইটির স্টাফদের বসবাসের জন্য ৪০টি বাসভবন নিয়ে ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলোর মাঝে চলাচলের জন্য ইউরোপীয় আদলে পথে বিছানো ছিল কালো পাথর। নওগাঁয় বর্তমানে সরকারি অফিস-আদালতের প্রায় সবই স্থাপিত হয়েছে সোসাইটির ভবনগুলোতে। গাঁজা চাষ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু সোসাইটির কার্যক্রম আজও চলমান। যদিও সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কাজের মাঝেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ । গাঁজা গোডাউনের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বেশ কয়েকটি ভবন। লাল রং করা ভবনগুলোর কোনোটি কার্যালয়, কোনোটি গুদামঘর । সেখান থেকে যমুনা নদীর পাড়ে একটি স্থাপনা কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থাপনাটি দেখে মনে হয় ঠিক যেন উপুর করে রাখা গাঁজা সেবন করার কলকে। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। আসলে এটি একটি চুল্লি। নষ্ট ও মানসম্পন্ন নয় এমন গাঁজা এই চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হতো।
বর্তমানে নেপালে উৎপাদিত গাঁজা বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষ চাষীর অভাব রয়েছে। নওগাঁ থেকে অনেক লোক সেখানে গিয়ে শ্রম ও জ্ঞান দিয়ে থাকেন।